কল্পনা করুন, বাংলাদেশের বিশাল এক উর্বর কৃষিজমি। এই জমিতে যুগ যুগ ধরে কিছু সফল ফসল—যেমন ধান, পাট বা আলুর চাষ হচ্ছে। আপনি একজন নতুন উদ্যোক্তা, এই জমিতে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চান। আপনার সামনে দুটো পথ খোলা আছে।
প্রথম পথটি বেশ সহজ ও পরিচিত। আপনি দেখলেন, সবাই আলু চাষ করে বেশ লাভ করছে। তাই আপনিও ঠিক করলেন, ভালো জাতের আলুর বীজ কিনে নিজের জমিতে চাষ শুরু করবেন। এই পথটা নিরাপদ মনে হয়, কারণ লাভের একটা নিশ্চয়তা দেখা যায়। কিন্তু মাঠে নামার পর আপনি বুঝলেন, আপনি একা নন। আপনার মতো হাজারো চাষী একই আলুর চাষ করছে।
ফসল ওঠার পর বাজারে গিয়ে আপনি দেখলেন আলুর ছড়াছড়ি। ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি। নিজের ফসল বিক্রি করতে আপনাকে দাম কমাতে হচ্ছে, অন্যের চেয়ে ভালো সারের বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে, বাজারের সেরা জায়গাটা পাওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। দিনশেষে যা লাভ থাকছে, তা দিয়ে কোনোমতে টিকে থাকা যায়, কিন্তু সমৃদ্ধি আসে না। এই মডেলটিকে বলা যায় “এক থেকে দশ”-এর চক্র। যা আছে, সেটারই আরও ভালো বা আরও বেশি উৎপাদন করা।
এবার দ্বিতীয় পথটির কথা ভাবুন। এটি একটু অচেনা, কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি সবার মতো আলুর চাষ না করে ভাবলেন, এই জমিতে কি এমন কিছু ফলানো যায়, যা আগে কেউ ফলায়নি? অনেক গবেষণা করে আপনি আবিষ্কার করলেন যে, এই জমির মাটি ও আবহাওয়া “কিনোয়া” (Quinoa) বা “ড্রাগন ফ্রুট”-এর মতো একটি অপ্রচলিত কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দামি ফসলের জন্য উপযুক্ত।
আপনি সেই নতুন বীজ বুনলেন। প্রথম প্রথম অনেকেই আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করলো। কিন্তু যখন আপনার ফসল ফলল, তখন বাজারে আপনিই একমাত্র বিক্রেতা। কোনো প্রতিযোগিতা নেই। আপনি নিজের দামে ফসল বিক্রি করছেন। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ এবং বড় বড় রেস্তোরাঁগুলো আপনার কাছ থেকে কিনছে, কারণ এই নতুন জিনিসটি আর কারও কাছে নেই। আপনি শুধু একজন চাষী নন, আপনি একজন পথপ্রদর্শক। এটাই হলো “শূন্য থেকে এক”-এর দর্শন—পুরোনো খেলা ভালোভাবে না খেলে, সম্পূর্ণ নতুন একটি খেলা তৈরি করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নতুন ‘বীজ’ বা ‘জমিন’ কোথায়?
আমাদের দেশের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে সবাই এখন সেই প্রথম পথের চাষী। সবাই ই-কমার্স, এফ-কমার্স, রাইড-শেয়ারিং আর কফি শপের জমিতে ভিড় করছে। কিন্তু আসল সুযোগ লুকিয়ে আছে সেইসব জায়গায়, যেখানে এখনো কেউ নজর দেয়নি। চলুন কিছু সম্ভাবনার মানচিত্র দেখি:
১. লবণাক্ত উপকূলের মিষ্টি সমাধান: বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বড় সমস্যা হলো লবণাক্ত মাটি, যেখানে সাধারণ ফসল ফলে না। সেখানকার মানুষ কৃষিকাজ থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
- পুরোনো চিন্তা (এক থেকে দশ): ওইসব এলাকায় গিয়ে চাল বা ডাল বিক্রি করার দোকান দেওয়া।
- নতুন বীজ (শূন্য থেকে এক): আপনি কি এমন একটি কৃষি-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পারেন যা লবণাক্ত পানিতে মাছ চাষ এবং সেই পানির উপরে সবজি চাষ (Aquaponics) করার একটি সমন্বিত মডেল তৈরি করে? আপনি স্থানীয় যুবকদের এই প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে ছোট ছোট খামার তৈরি করতে পারেন। আপনি লবণ-সহনশীল ফসলের জাত (যেমন: বিশেষ জাতের তরমুজ, ভেটকি মাছ) নিয়ে এসে একটি নতুন কৃষি বিপ্লব ঘটাতে পারেন। এই বাজারে আপনার কোনো প্রতিযোগী থাকবে না। আপনি একটি বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন অর্থনীতির দরজা খুলে দেবেন।
২. ফেলে দেওয়া সম্পদের সোনালী ফসল: প্রতিদিন ঢাকা শহরের লক্ষ লক্ষ টন গৃহস্থালির বর্জ্য ভাগাড়ে জমা হয়, যা পরিবেশ দূষিত করে। সবাই এটাকে সমস্যা হিসেবেই দেখে।
- পুরোনো চিন্তা (এক থেকে দশ): একটি পরিচ্ছন্নতা কর্মী সরবরাহকারী এজেন্সি খোলা।
- নতুন বীজ (শূন্য থেকে এক): আপনি যদি এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেন, যেখানে প্রতিটি বাড়ি থেকে পচনশীল বর্জ্য (যেমন: তরকারির খোসা, খাবারের উচ্ছিষ্ট) সংগ্রহ করে তা থেকে উচ্চমানের জৈব সার বা বায়োগ্যাস তৈরি করা হয়? এই সার আপনি শহুরে ছাদ-বাগানীদের কাছে বা গ্রামের কৃষকদের কাছে বিক্রি করতে পারেন। আপনি বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করছেন। আপনি এমন একটি মডেল তৈরি করছেন যা পরিবেশবান্ধব এবং লাভজনক। এই খেলার নিয়ম আপনিই লিখবেন।
৩. ঐতিহ্যের সুতোয় আধুনিকতার নকশা: আমাদের দেশের মসলিন, জামদানি বা রাজশাহীর সিল্কের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল। কিন্তু সঠিক বিপণন ও আধুনিকতার অভাবে এই শিল্পগুলো ধুঁকছে।
- পুরোনো চিন্তা (এক থেকে দশ): একটি ফেসবুক পেজ খুলে জামদানি শাড়ি বিক্রি করা, যেখানে আপনার মতো আরও শত শত বিক্রেতা আছে।
- নতুন বীজ (শূন্য থেকে এক): আপনি যদি এমন একটি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন যেখানে প্রতিটি শাড়ির কারিগরের গল্প, তার ছবি এবং শাড়িটি তৈরি করার পুরো প্রক্রিয়া ভিডিওসহ তুলে ধরা হয়? যদি ‘ব্লকচেইন’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি শাড়ির সত্যতা নিশ্চিত করার সার্টিফিকেট দেন? যদি অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR) ব্যবহার করে বিদেশের কোনো ক্রেতা ভার্চুয়ালি শাড়িটি ‘ট্রাই’ করে দেখতে পারেন? তখন আপনি শুধু একটি শাড়ি বিক্রি করছেন না, আপনি একটি অভিজ্ঞতা, একটি বিশ্বাস এবং একটি ঐতিহ্য বিক্রি করছেন। এই বাজারে আপনার দাম এবং সম্মান দুটোই হবে আকাশছোঁয়া।
কীভাবে বুনবেন আপনার নতুন বীজ?
- ছোট্ট এক টুকরো জমি দিয়ে শুরু করুন: পুরো বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার চিন্তা না করে খুব ছোট এবং নির্দিষ্ট একটি সমস্যা বা জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য বানান। যেমন, শুধু গুলশানের রেস্তোরাঁর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বা শুধু মানিকগঞ্জের তাঁতিদের নিয়ে কাজ করুন। সেই ছোট বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করুন। আপনার সাফল্যই আপনাকে বড় হওয়ার পথ দেখাবে।
- গোপন জ্ঞান অর্জন করুন: এমন একটি সত্য বা বিশ্বাস খুঁজে বের করুন, যা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ মাথা ঘামায় না বা আপনার সাথে একমত নয়। যেমন: “বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরা বিশ্বমানের সফটওয়্যার টেস্টিং করতে সক্ষম” অথবা “শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস নয়, বরং সময়মতো ও নির্ভরযোগ্য পাবলিক বাসই ঢাকার মানুষের আসল চাহিদা”। এই গোপন বিশ্বাসই আপনার নতুন পথের দিশারী।
- প্রযুক্তিকে বানান আপনার লাঙল: আপনার ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি হতে হবে কোনো না কোনো অনন্য প্রযুক্তি বা প্রক্রিয়া। এটাই আপনার পরিখা, যা প্রতিযোগীদের সহজে ঢুকতে দেবে না। সেটা হতে পারে একটি বিশেষ সফটওয়্যার, একটি নতুন উৎপাদন কৌশল বা একটি অভিনব ডেলিভারি সিস্টেম।
শেষ কথা: আপনার ফসল, আপনার উত্তরাধিকার
ব্যবসা মানে শুধু টাকা উপার্জন নয়। ব্যবসা হলো নিজের একটি ছাপ রেখে যাওয়া। আপনি কি সেই হাজারো চাষীর ভিড়ে হারিয়ে যেতে চান, যারা একই জমিতে একই ফসল ফলিয়ে একে অপরের সাথে লড়াই করছে? নাকি আপনি সেই অগ্রদূত হতে চান, যাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মনে রাখবে একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলার জন্য?
বাংলাদেশের পরবর্তী সফলতম অধ্যায়টি কোনো বিদেশি ধারণার সফল অনুকরণ হবে না। সেটি হবে আমাদের নিজেদের সমস্যা থেকে জন্ম নেওয়া কোনো মৌলিক ও অভিনব সমাধান। সেই শূন্য থেকে এক হয়ে ওঠার গল্পটি লেখার সুযোগ আপনার হাতেই। আপনার জমিন প্রস্তুত, এখন শুধু নতুন বীজটি বোনার অপেক্ষা।